Categories: কৌশল

ফোন ব্লাস্টের ক্ষেত্রে ইউজারের দায়বদ্ধতা কতটা? ভয় না পেয়ে প্রতিকার জেনে নিন

আজকাল প্রায়ই কোথাও না কোথাও ফোন ব্লাস্টের ঘটনার কথা শোনা যাচ্ছে এবং যখনই এই ধরনের ঘটনার কথা শোনা যায় আমরা সাধারণত আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। কারণ ফোন কম বেশি সব সময়‌ই আমাদের খুব কাছাকাছি থাকে, তাই ফোনে কোনোরকম দুর্ঘটনা ঘটলে আমাদের শারীরিক ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা থেকেই যায়। কিন্তু এখন প্রশ্ন হল, ফোনে বিস্ফোরণ কেন ঘটে? এবং স্মার্টফোনে বিস্ফোরণ ঘটলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় কোম্পানিগুলি তাদের দায় এড়াতে চায় ও সম্পূর্ণ দোষ গিয়ে পড়ে ইউজারের ঘাড়ে, কেন? এমনটা কি আদৌ উচিত? ফোন লঞ্চের সময় কোম্পানি বিভিন্ন ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে অথচ কোনো গন্ডগোল হলেই দায়ী হয়ে যায় ইউজার। তবে চলুন জেনে নেওয়া রাক এই ধরনের ঘটনায় কি সত্যিই ইউজার আসল দোষী? এবং যদি ইউজার দায়ী না হয় ও কোম্পানি দায়বদ্ধতা এড়িয়ে যেতে চায় তাহলে কিভাবে এই সমস‍্যার সমাধান করবেন?

আরও পড়ুন : এই পাঁচটি পদ্ধতি অবলম্বন করে আটকাতে পারবেন আপনার ফোনের ওপর চলমান নজরদারি

কেন ফোনে বিস্ফোরণ ঘটে?

মোবাইল ফোনে ব‍্যবহৃত লিথিয়াম আয়ন ব‍্যাটারীতে সাধারণত তিন ধরনের উপাদান থাকে। প্রথম, কোবাল্ট অক্সাইড পজিটিভ ইলেকট্রড যা ক‍্যাথোড নামে পরিচিত। দ্বিতীয়, গ্ৰাফাইট কার্বন নেগেটিভ ইলেকট্রড যা অ্যানোড নামে পরিচিত। এবং তৃতীয় ও সর্বশেষ, ইলেকট্রোলাইট কেমিক্যাল।

মোবাইল ব‍্যাটারী তৈরির সময় ক‍্যাথোড ও অ্যানোড আলাদাভাবে রাখা হয়। এদের আলাদা রাখার জন্য ইনসুলেশন টেপ, প্লাস্টিক স্ট্রিপ বা রাবারের স্ট্রিপ ব‍্যবহার করা হয়। কিন্তু কোনো ভাবে যদি এই দুটি পদার্থ সংস্পর্শে আসে তবে বিস্ফোরণ ঘটে। মোবাইল ফোনে ব‍্যাটারী ছাড়া এমন কোনো পদার্থ নেই যা বিস্ফোরণের কারণ হতে পারে। যে কোনো কারণে এই দুটি পদার্থ সংস্পর্শে আসতে পারে। যেমন শর্ট সার্কিট, ম‍্যানুফ‍্যাকচারিং ফল্ট, ওভার হিট বা অতিরিক্ত চাপের ফলে।

তবে কি ইউজার‌ই দোষী?

ফোন ব্লাস্ট হলেই দেখা যায় ইউজারকে দোষী সাব‍্যস্ত করে কেস বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু জানিয়ে রাখি অধিকাংশ ঘটনায় কিন্তু ইউজারের আদৌ কোনো দোষ থাকে না। সেইসব ক্ষেত্রে কোম্পানিই দোষী। আমরা এবিষয়ে উদাহরণ পেশ করেছি এবং সুপ্রিম কোর্টের উকিল ও সাইবার আইন বিশেষজ্ঞ পবন দুগ্গালের মতামত নিয়েছি।

1. ম‍্যানুফ‍্যাকচারিং ফল্ট: একে নির্মাণ ত্রুটিও বলা যেতে পারে। যে কোনো ফোন তৈরির সময়‌ও ভুল হতে পারে এবং এর জন‍্য‌ও ফোনে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। যেমন গ‍্যালাক্সি নোট 7 এর ক্ষেত্রে দেখা গেছিল যে ফোনে বিস্ফোরণ ঘটায় স‍্যামসাং পুরো লট মার্কেট থেকে ফেরত নিয়ে নেয়। এক্ষেত্রে কোম্পানি নিজের দোষ স্বীকার করে নিলেও সব ক্ষেত্রে এমনটা হয় না। কোনো না কোনো অজুহাত দেখিয়ে কোম্পানি ইউজারের ঘাড়ে দোষ দিয়ে দেয় যাতে মার্কেটে তাদের রেপুটেশন খারাপ না হয়।

সত্যিই কি ইউজার দায়ী? ইউজার কোনোভাবেই দোষী নয়। এবিষয়ে পবন দুগ্গাল বলেছেন, “যদি ফোনে বিস্ফোরণ ঘটে তবে কোম্পানিই সম্পূর্ণভাবে দায়ী। কোম্পানি কোনোভাবেই বলতে পারে না যে ইউজার দোষী। কারণ কোনো ইউজার নিশ্চয়ই নিজে থেকে তাঁর ফোনে আগুন লাগাবেন না। প্রস্ততির সময় কোনো না কোনো ভুল থেকে থাকতেই পারে যার ফলে ফোন ব্লাস্ট হয়। অধিকাংশ কোম্পানি দায়বদ্ধতা এড়ানোর জন্য ইউজারের ঘাড়ে দোষ ঠেলে দেয়।”

2. খারাপ চার্জার ব‍্যবহার: ফোন ব্লাস্টের অন‍্যতম কারণ মনে করা হয় নকল বা আনব্র‍্যান্ডেড চার্জারের ব‍্যবহার এবং কোম্পানি এই অজুহাতটাই সবচেয়ে বেশি দিয়ে থাকে। ফোন ব্লাস্ট হলেই কোম্পানিকে বলতে শোনা যায় নকল চার্জার ব‍্যবহার করা হয়েছিল তাই ফোনে বিস্ফোরণ হয়েছে এবং তাই কোম্পানি কোনোভাবেই দায়ী নয়।

আরও পড়ুন : কোথায় পাবেন পুরোনো ফোনের জন্য সবচেয়ে বেশি দাম? জেনে নিন কিভাবে বেচবেন

সত্যিই কি ইউজার দায়ী? তবে এমন নয় যে খারাপ চার্জারের জন্য ফোনে বিস্ফোরণ ঘটলে সেক্ষেত্রেও কোম্পানিই দায়ী। এবিষয়ে পবন দুগ্গাল জানিয়েছেন, “বর্তমানে ফোন কেনার সময় ফোনের সঙ্গে নিত্য ব‍্যবহার্য সব জিনিস দেওয়াই থাকে। তাই যদি আপনি বলেন যে আপনি অন্য কোনো চার্জার ব‍্যবহার করছেন বা জল লেগেছে তাই খারাপ হয়ে গেছে সেক্ষেত্রে আইনত আপনিই ভুল। প্রতিটি কোম্পানি বেশ কিছু টেস্ট ও টেকনিক্যাল রিপোর্ট পেশ করার পর ফোন লঞ্চ করে। তারপরেই ফোন বেচার প্রমোশন করা হয়। এত কিছুর পর আপনার‌ও অবশ্যই কিছু দায়িত্ব থেকে যায়। এবার সব নিয়ম ঠিকমতো মেনে চলার পরেও যদি বিস্ফোরণ ঘটে তবে তো কোম্পানিই দায়ী।”

অবশ্যই এই কথাগুলি ঠিক। কারণ খারাপ চার্জারের ফলে যদি কম বা বেশি পাওয়ার সাপ্লাই হয় তবে ফোনটি অফ হয়ে যাওয়া উচিত, ব্লাস্ট নয়। বিস্ফোরণ হলে কোম্পানির একটু হলেও দায়বদ্ধতা থাকেই। যদি অন‍্য চার্জার ব‍্যবহারের ফলে ফোন ব্লাস্ট ড়ত তবে প্রতিদিন লাখো লাখো ফোন ব্লাস্ট হত। তবে আমরা কখনোই বলব না নকল বা অন্য চার্জার ব‍্যবহার করা উচিত।

3. তরল পদার্থের কারণে: অনেক সময় কোম্পানিকে বলতে শোনা যায় ফোনে জল গেছে বা লিকুইড ড‍্যামেজের কারণে ফোনে ব্লাস্ট হয়েছে। কিন্তু এটি ভুল। পবন দুগ্গাল স্পষ্ট জানিয়েছেন আইন এই কথা মানে না। ইউজারদের ভুল বোঝানোর জন্য এই কথা প্রচার করা হয়।

সত্যিই কি ইউজার দায়ী? ভারতের আবহাওয়া যথেষ্ট গরম, তাই ফোনে ঘাম বা কোনোভাবে কোনো তরল পদার্থ যেতেই পারে। এক্ষেত্রে ফোন বন্ধ হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক হলেও ব্লাস্ট কোনোমতেই নয়। ফোন খারাপ হলে ইউজার দায়ী, তবে বিস্ফোরণের দায় কোম্পানির‌ই।

আরও পড়ুন : জেনে নিন কিভাবে অ্যান্ড্রয়েড ফোনের ডিলিট হয়ে যাওয়া ফোটো ও ভিডিও রিকভার করবেন?

4. চার্জের সময় কল: বলা হয় ফোন চার্জ করার সময় কল বা ম‍্যাসেজ করলে ফোন ব্লাস্ট হতে পারে। স্বাস্থ্যের সুরক্ষার জন্য এমনটা করা উচিত নয় ঠিকই কিন্তু তা বলে ব্লাস্ট হ‌ওয়ার কথা নয়। এই জন্য দায়ী কোম্পানিই, তাদের‌ই ফোনে কোনো গন্ডগোল আছে।

সত্যিই কি ইউজার দায়ী? গ্ৰাহক দায়ী নয়। এই ধরনের ঘটনা ঘটলে ইউজার ক্ষতিপূরণ চাইতে পারে। সব ফোনে এমন টেকনোলজি দেওয়া থাকে যাতে ফোন চার্জ করার সময়‌ও কল করা যায়।

5. ওভার হিটিং বা অতিরিক্ত গরম হয়ে যাওয়া: অনেক সময় শোনা যায় ওভার হিটিং বা অত‍্যাধিক গরম হ‌ওয়ার জন‍্য‌ও ফোন ব্লাস্ট হয়। কোম্পানিও অনেক সময় “ফোন ওভার হিটের কারণে ব্লাস্ট হয়েছে” বলে বেঁচে যায়। কিন্তু সব ফোনে থার্মাল লক সিস্টেম থাকে যার ফলে ফোন মাত্রাতিরিক্ত গরম হলে ফোনটি অফ হয়ে যায়।

সত্যিই কি ইউজার দায়ী? এক্ষেত্রেও ইউজার দায়ী নয়। ফোন ব্লাস্ট ফোনের টেকনিক্যাল ত্রুটির জন্য হয়। আর যদি সত্যিই গরম হয়ে ফোনে বিস্ফোরণ ঘটে তবে সেটা কোম্পানির আওতায় আসে, তাই এটি কোম্পানির দায়বদ্ধতা। তাই এক্ষেত্রেও ক্ষতিপূরণ দাবি করা যায়।

আরও পড়ুন : জেনে নিন ভারতে কিভাবে কাজ করবে আইফোন 10এসের ডুয়েল সিম ফাংশন ও ই-সিম কি?

6. চাপ বা অতিরিক্ত ওজনের জন্য: অনেক সময় বেশি পরিমাণে চাপ বা ওজন পড়ার ফলেও ফোনে বিস্ফোরণ হয়।

সত্যিই কি ইউজার দায়ী? হ‍্যাঁ, এই ক্ষেত্রে ইউজার‌ই দায়ী। আপনাদের সব সময় লক্ষ্য রাখা উচিত যাতে ফোনের ওপর মাত্রাতিরিক্ত চাপ বা ওজন না পড়ে।

কোম্পানির বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ কিভাবে নেবেন?

আশা করি এতক্ষণে বুঝে গেছেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ফোন ব্লাস্ট হলে কোম্পানিই দায়ী হয়। কিন্তু যদি কোম্পানি গ্ৰাহকের অভিযোগ মেনে নিতে অস্বীকার করে তবে সাধারণ মানুষ কোর্টের দারস্থ হতে পারে।

এবিষয়ে পবন দুগ্গাল বলেছেন, “ফোনে বিস্ফোরণ হলে সবার আগে কোম্পানির কাছে লিখিত অভিযোগ জানানো উচিত এবং যেহেতু এটি বিস্ফোরণের ঘটনা তাই নিকটবর্তী থানায় এফ‌আইআর করা প্রয়োজন। আপনি অনলাইন অভিযোগ জানাতে চাইলে https://cybercrime.gov.in/ ভিজিট করতে পারেন। যদি এরপরও কোম্পানি আপনার অভিযোগ নিতে না চায় তবে আপনি ক্রেতা সুরক্ষা আইনের সাহায্য নিতে পারেন। আপনি আপনার জেলা কোর্টে, রাজ‍্যে বা ন‍্যাশানাল কমিশনে আপনার কনজিউমার পিটিশন জমা দিতে পারেন। এছাড়া আমাদের দেশে আইটি অ্যাক্টের জন্য যে স্পেশাল কোর্ট আছে সেখানেও যেতে পারেন। ভারতের সংবিধান সেকশন 79 আইটি অ্যাক্টের ধারা অনুযায়ী এইসব ঘটনার বিচার করা হয়।”

আরও পড়ুন : 

তিনি আর‌ও বলেছেন, “যদি কোম্পানি কোনো কিছুতেই পাত্তা না দেয় তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় সব ডিটেইলসে লিখুন। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও টুইটারের মতো প্ল‍্যাটফর্মে দুর্ঘটনার কথা বেশি বেশি করে শেয়ার করে যত বেশি সম্ভব সাধারণ মানুষ ও এই সম্বন্ধীয় আধিকারিকদের নজরে আসে। এই ব‍্যাপারে আবার কোম্পানি খুব দ্রুত পদক্ষেপ নেয় যাতে তাদের রেপুটেশন খারাপ না হয়।”

ফোন বিস্ফোরণে কতটা ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়?

এবিষয়ে পবন দুগ্গাল জানিয়েছেন, “ক্রেতা সুরক্ষা আইনের কথা অনুযায়ী যত বেশি ক্ষতি হবে তত বেশি ক্ষতিপূরণ দাবি করা যায়। যদি বিস্ফোরণে কোনোভাবে মুখ, চোখ বা কান ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ অনেক বেশি হবে। কিন্তু যদি কোনো শারীরিক ক্ষতি না হয় তবে কোর্টের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ফোনের বদলে নতুন ফোন এবং সঙ্গে কিছু জরিমানা দিয়ে কেস মিটিয়ে নিতে বলা হয়।”

আমাদের ফেসবুকে ফলো করার জন্য এখানে ক্লিক করুন